আগের রাতে সবাইকে বলে দেয়া হয়েছিলো আমরা ভোর সাড়ে ছয়টা নাগাদ বেরিয়ে যাবো, তাই প্রায় সকলেই নির্দিষ্ট সময়ে তৈরি হয়ে গেল। বাদল দা’র রেস্টুরেন্টে নাশতা সেরে আমরা বারো খানা রিকশায় চেপে রওনা দিলাম, প্রথম দ্রষ্টব্য চিনা মাটির পাহাড়।
সোমেশ্বরী নদীর তীরে এসে নৌকোয় করে নদী পেরুলাম।
স্বপ্নের সোমেশ্বরী নদী। উত্তরের গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা সোমেশ্বরী নদীর আদি নাম ছিলো ‘সমসাঙ্গ’। ওই নদীর তীরে বসবাস করত ধীবররা। তাদের বলা হতো ‘পাটুনি’। বাইশা গারো নামের এক গারো তখন ওই অঞ্চল শাসন করতেন। কিন্তু বাইশা গারোর ওপর ধীবররা সন্তুষ্ট ছিল না। তবে শক্তির অভাবে তারা তাকে মেনে নিতে বাধ্য। ১২৮০ খ্রিস্টাব্দে সোমেশ্বর পাঠক কামরূপ কামাখ্যাসহ বিভিন্ন তীর্থ দর্শন শেষে গারো পাহাড়ে আসেন।
এখানকার সৌন্দর্য আর সুমসাং নদী তীরের নীরবতা সোমেশ্বর পাঠক মুগ্ধ হয়ে যান। সিদ্ধিলাভের জন্য উত্তম স্থান হিসেবে তিনি এটিকে বেছে নেনে। এলাকার জেলেদের সঙ্গে ক্রমেই তার যোগাযোগ গড়ে ওঠে। সোমেশ্বর ছিলেন অসামান্য বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও বলিষ্ঠ। ধীবররা তাকে দেবতা এবং ত্রাতা মনে করতে থাকে। তাকে ঘিরেই গড়ে ওঠে দুর্গাপুর গ্রাম (যা বর্তমানে নেত্রকোণার একটি উপজেলা)।
সোমেশ্বর পাঠক সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন সঙ্গে করে নিয়ে আসা লক্ষ্মীনারায়ণের বিগ্রহ। পরে তিনি আগের বাসস্থান কান্যকুব্জ থেকে স্বজনদের নিয়ে এসে বসতি গড়েন সেখানে। এতে তার শক্তি আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। এক সময় সুযোগ বুঝে ওই এলাকার অত্যাচারী শাসনকর্তা বাইশা গারোকে পরাজিত করে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সুসং রাজ্য’। ওই এলাকার ধীবররা সোমেশ্বর পাঠককে সাক্ষাৎ দেবতা মনে করত। তারা ভাবত, জেলেদের উন্নতির জন্যই সোমেশ্বর ঠাকুর নিজ হাতে সুসং রাজ্য গড়েছেন। তারা এও মনে করত, সুসংয়ের মানুষের পানিকষ্ট দূর করতেই প্রভু সোমেশ্বর নিজ হাতের ‘ভৃঙ্গার’ থেকে পানি ঢেলে দেওয়ায় সৃষ্টি হয় সোমেশ্বরী নদী।
তবে অনেকেরই ধারণা, উত্তর পাহাড়ের ঝর্ণাধারা ‘সমসাং’ এর গতিপথ পরিবর্তন করে সোমেশ্বর পাঠক তা নিয়ে এসেছিলেন সুসংয়ের রাজধানী দুর্গাপুরের কাছে। এ কারণেই ওই নদীর নাম হয় সোমেশ্বরী নদী।
সোমেশ্বরী নদী পেরিয়ে মাটির এবড়ো থেবড়ো পথে পুরো শরীরে ভাইব্রেশন নিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেকের বেশী সময় যাত্রা শেষে পৌছলাম চিনা-মাটির পাহাড়। বিরিশিরির মূল আকর্ষণ বিজয়পুর চীনামাটির খনি। ছোট বড় টিলা-পাহাড় ও সমতল ভূমি জুড়ে প্রায় ১৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৬০০ মিটার প্রস্থ এই খনিজ অঞ্চল। খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৭ সালে এই অঞ্চলে সাদামাটির পরিমাণ ধরা হয় ২৪ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন, যা বাংলাদেশের ৩শ’ বৎসরের চাহিদা পুরণ করতে পারে। চীনামাটির পাহাড় গুলো সাদা রং এর।
কিছু কিছু জায়গায় মেরুন বা হালকা লাল রঙ বিদ্যমান। পাহাড় থেকে মাটি তোলায় সেখানে হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে। বেশির ভাগ হ্রদ্রের পানির রঙ নীল। কিছু কিছু জায়গায় সবুজাভ নীল। কিছু জায়গায় সাদা, কিছু জায়গায় লাল। তবে হ্রদ থেকে পানি তুলে খনন করার জন্য লাল পানি এখন আর নেই। হ্রদের উপড় পাহাড় চূড়ায় কিছুক্ষণ জিড়িয়ে নিতে দারুন লাগবে। বিজয়পুর এর ট্যুরিষ্ট সিজন শীতকাল। তখন পানী গাঢ নীল থাকে। শীতকাল বলে আমরা নীল পানির দর্শন পেলাম। চারিপাশ ঘুরে দেখার পাশাপাশি চলল ফটোসেশন। ঘণ্টা দেড়েক সেখানে কাটিয়ে আমরা রওনা দিলাম সাধু জোসেফের ধর্মপল্লীস্থ “রানীখং গির্জা”র উদ্দেশ্যে।
আবারো নদী পেরুলাম নৌকা করে, নদী পার হয়েই পেলামহাজং মাতা শহীদ রাশিমনি স্মৃতিসৌধ।
রানীখং পাহাড়ের পাশেই রয়েছে কুমুদিনি হাজংয়ের বাড়ি। সেখানে বারাতলী গ্রামে রয়েছে হাজং মাতা শহীদ রাশিমনি স্মৃতিসৌধ। দুর্গাপুর শহর থেকে এ জায়গাটির দূরত্ব উত্তর দিকে ৫ কিলোমিটার। রাশিমনি একজন হাজং নেত্রী। রশিমনি হাজং (১৯০৮ - জানুয়ারি ৩১, ১৯৪৬) ১৯৪৬ সালে সংঘটিত ময়মনসিংহের টঙ্ক আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী নেত্রী। তিনি এ আন্দোলনের প্রথম শহীদ। টঙ্ক আন্দোলনে বিপ্লবী নেতা মনিসংহের পরেই রশিমনি হাজং এবং কুমুদিনী হাজং এর অবদানের কথা স্মরণ করা হয়। নেত্রকোনা জেলায় রশিমনি হাজং-এর স্মরণে নির্মিত একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে।
হাজংদের অধিকার রক্ষার প্রতীক রাশিমনি হাজং সম্প্রদায়ের কাছে হাজং মাতা নামেই পরিচিত। টংক প্রথার বিরুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি মহিলাদেরও সংগঠিত করার কাজে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। তার নেতৃত্বে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। রাশিমনির বাড়ি ছিল পাশের গ্রাম বগঝগড়ায়।
সেদিন বিরিশিরি থেকে একজন ম্যাজিস্ট্রেট ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনী নিয়ে মুল্লাগড়া গ্রামের টংক আন্দোলনের নেতা লংকেশ্বর হাজং, গজেন্দ্র হাজং, ইসলামেশ্বর হাজংকে ধরতে এসে তাদের না পেয়ে লংকেশ্বর হাজংয়ের সদ্য বিবাহিত স্ত্রী কুমুদিনি হাজংকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে তার ওপর চলে অকথ্য অত্যাচার। সে খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন আরো জোরদার হয়। ২০০৪ সালের ৩১ জানুয়ারি হাজং মাতা শহীদ রাশিমনি স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন কুমুদিনি হাজং। সেখানে কিছু ছবি তুলে আমরা গেলাম রানিখং পাহারের গির্জা এবং সাধু জোসেফের ধর্মপল্লী দেখতে।
বিরিশিরি বা দুর্গাপুরে সোমেশ্বরী নদীর পাশের পাহাড়টির নাম রানীখং পাহাড়।
এ পাহাড়ে রয়েছে সাধু যোশেফের ধর্মপল্লী। এটি আসলে একটি গির্জা। ১৯০৯ সালে রানীখং এলাকার পাঁচ প্রবীণ গারো নেতা ঢাকার বিশপ হান্টের কাছে যান এবং খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করে এই এলাকায় ধর্মপ্রচারের আহ্বান জানান। ১৯১০ সালে ঢাকার বিশপ লিনেবর্ণের নির্দেশে ফাদার ফ্লেবি রানীখং আসেন এবং ধর্মপ্রচার শুরু করেন। গারোরা স্থায়ীভাবে গির্জা স্থাপনের জন্য ফাদারকে অনুরোধ করলে ১৯১৫ সালে ফাদার ফ্রাসিস্ট তৎকালীন বাজারদরের ৪গুণ বেশি দাম দিয়ে সুসঙ্গ জমিদারের কাছ থেকে রানীখং পাহাড়টি কিনে নেন এবং পাহাড়ের নিচে বিদ্যালয় ও ওপরে গির্জা তৈরি করেন। নাম দেন সাধু জোশেফ ধর্মপল্লী। পর্যটকেরা কেবল এই পল্লী দেখতেই এখানে আসে না, আসে আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতেও। এখানকার চুড়া থেকে সোমেশ্বরী নদীর যে ভিউ দেখা যায় তা এক কথায় অসাধারণ, ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।
এখান থেকে আমাদের পরবর্তী স্পট বিজয়পুরস্থ বিজিবি ক্যাম্প। এখানকার চুড়ো থেকে গারো পাহাড়ের রুপ, ওপারের ভারত সিমান্ত আর সোমেশ্বরী নদীর অপরূপ রূপ আপনাকে করবে সন্মোহিত। বরফ শীতল হাঁটু জলে জলকেলি তুলনাহীন। আপনি একটা সারা বিকেল এখানে কাটিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু আমাদের তাড়া ছিল, তাই ফিরতি পথ ধরলাম।
ঢাকার মহাখালী থেকে সরাসরি বাস যায় বিরিশিরি। ময়মনসিংহ অথবা নেত্রকোনা হয়েও যেতে পারেন। নেত্রকোনার বাসে শ্যামগঞ্জ নেমে মোটরসাইকেলে যাওয়া যায় বিরিশিরি। ঢাকা থেকে বাস ভাড়া ২০০-৩০০ টাকা আর মোটরসাইকেল ভাড়া ৩৫০-৫০০ টাকা। সরাসরি বিরিশিরি’র ভাড়া ২৫০-৩০০ টাকা। বিআরটিসির বাস সার্ভিস রয়েছে বিরিশিরি রুটে। তিন-চারটি হোটেল-রেস্ট হাউজ আছে। তবে ওয়াইএমসি’র গেস্ট হাউজ সবচেয়ে ভালো অপশন। খাবার জন্য বাদল দা’র লাকি হোটেল ছাড়াও আরও কয়েকটি খাবার দোকান রয়েছে আশেপাশে।
তো? যারা এখনো যান নাই, কবে যাচ্ছেন?
ভ্রমণকালঃ ০৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪
মন্তব্যসমূহ